মো. শফিউল ইসলাম সৈকত, ঝালকাঠি ঃ ঝালকাঠি-১ আসনে আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামীলীগ ও বিএনপির একাধিক প্রার্থীর সমর্থনে দলে গ্রুপিং বিভক্তি বেড়েই চলছে। কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পালন হচ্ছে পৃথকভাবে। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই উত্তেজনা বাড়ছে নিজেদের মধ্যে।
ঝালকাঠি-১ আসনে আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামীলীগের একাধীক প্রার্থীর সমর্থনে নেতাকর্মীরা দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পরেছে। আসনের বর্তমান এমপি বজলুল হক হারুন বিগত নির্বাচনে তিন তিনবার এমপি হলেও নেতাকর্মীদের মাঝে গ্রহন যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। এমনটাই মনে করেন দলীয় অনেকেই। এ অবস্থায় আগামী নির্বাচনে আমির হোসেন আমুকে এ আসনে প্রার্থী করার দাবি উঠেছে। যদিও এ দাবির সমর্থনে আমুর পক্ষ থেকে নেতৃবৃন্দ এখন পর্যন্ত কোন প্রতিক্রিয়া বা মতামত জানায়নি। পাশাপাশি দলীয় মনোনয়ন চাচ্ছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোঃ ইসমাইল এবং কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক উপকমিটির সদস্য এম. মনিরুজ্জামান মনির। এ তিন প্রার্থীকে কেন্দ্র করে বিভক্তি ও দলীয় কোন্দল প্রকাশ্যে রুপ নিয়েছে। তবে এ আসনে অধিকাংশ ভোটারের মতামত এই ৩ জনের মধ্যেই একজনকে মনোনয়নে বিবেচনা করবে দল।
এ বিষয়ে রাজাপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সদস্য মোঃ দেলোয়ার হোসেন ফরাজী বলেন, বর্তমান এমপি এই আসন থেকে এমপি নির্বাচীত হলেও দুই উপজেলায় কর্মী সমর্থক তৈরী করতে পারেনি। বিগত দিনে তার কাছে আমাদের কোন মুল্যায়ন হয়নি। আলোচনায় থাকা অপর প্রার্থী মনিরুজ্জামান বয়সের দিক থেকে অনেক জুনিয়র। তিনি এসে গণসংযোগ করে চলে যান। গালুয়া ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সভাপতি সৈয়দ মনিরুজ্জামান পনু বলেন, এমপি হারুন সাহেব সরকারী প্রগ্রামসহ কেন্দ্রীয় নির্দেশনা বাস্তবায়নে এলাকায় আসেন। তখন নেতাকর্মীদের সাথে মিলিত হন। কিন্তু এখানে একাধীক নেতা প্রার্থী হওয়ায় তারা এমপির বিরোধিতা এবং অপপ্রচার চালাচ্ছেন। এছাড়া ইউনিয়ন পর্যায়ের অনেক নেতারাই এমপির কাছ থেকে টিআর, কাবিখার সুবিধা নিচ্ছে। তারাই আবার আরেক নেতাকে সমর্থন করছেন। এ আসনে এমপি আমির হোসেন আমু ও বজলুল হক হারুন সমর্থিত নেতা কর্মীরা দ্বিধা বিভক্তি প্রকাশ্যে রুপ নিয়েছে। এমপি বজলুল হক হারুন বিরোধীরা চাচ্ছে এবার আমির হোসেন আমুকে মনোনয়ন দেয়া হোক। তাদের অভিযোগ দলীয় এমপি হয়েও নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করেনি এমপি হারুন। যারা দলের সাথে সম্পৃক্তই ছিলনা এবং এমপি হারুনের বিরোধীতা করেছে তাদেরকেই সাথে নিয়ে তিনি তার কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। কাঠালিয়া শৌলজালিয়া ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান মাহামুদ হোসেন রিপন বলেন, বজলুল হক হারুন এমপি হওয়ায় বিগত দিনে এই আসনে কোন চাাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, কমিশন বানিজ্য ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড নেই। এলাকার মানুষ সুখে আছে। উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এমপি হারুনে সমর্থক তরুণ সিকদার বলেন, ২০১৯ সনে সম্মেলনের মাধ্যমে আমাদের না জানিয়ে কমিটি করা হয়েছে। এতে এমপি বিরোধী এবং ৩৭ জন অনুপ্রবেশকারিদের নিয়ে ঐ কমিটি করা হয়। তাই এমপিকে সাথে নিয়ে আমরা পৃথক কমিটি করে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছি। এমপির কারণে কাঠালিয়ায় প্রশাসনিক কাজে হস্তক্ষেপ ও অবৈধ সুপারিশ নেই। তাই কাঠালিয়া আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে আগামী সংসদ নির্বোচনে বজলুল হক হারুণের মনোনয়ন প্রদানের বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনা করবে আওয়ামীলীগ সভানেত্রী।
অপর দিকে কাঠালিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান এমাদুল হক মনির বলেন, আমির হোসেন আমু কাঠালিয়া আওয়ামীলীগে শৃংখলা ফিরিয়ে এনেছে। তৃণমুল নেতাকর্মীদের চাওয়া আমুর সহযোগীতায় সফল হয়েছে। তিনি এলাকায় আসতে না পারলেও আমারই তার পক্ষে কাজ করছি। আমাদের সবার প্রত্যাশা এ আসন থেকে আমু ভাইকে মনোনয়ন দেয়া হোক। মনির বলেন, অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী মো. মনিরুজ্জামনের প্রতি দলের কোন সমর্থন নেই। কাঠালিয়ায় যারা দলের নেতাকর্মী দাবি করছে তারা কমিটিতে নেই। এরা বিগত দিনে জামায়াত, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিতে থাকলেও এমপি তাদের সাথে রেখেছে। কাঠালিয়ার ১ জন ছাড়া বাকি সব ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামীলীগের সাথে আছে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঝালকাঠি-১ (রাজাপুর-কাঠালিয়া) আসনে তৃনমুল আওয়ামীলীগ ও বিএনপির দলীয় কোন্দল প্রকাশ্যে রুপ নিয়েছে। একাধিক প্রার্থী থাকায় তাদের সমর্থনে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পরেছে নেতাকর্মীরা। মনোনয়ন প্রত্যাশিরাও এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে কর্মী সমর্থকদের কাজে লাগাচ্ছে। শুধু কর্মসূচীতেই নয় দ্বন্দ্বের জেরে গঠিত হয়েছে একাধিক কমিটি।
আসনটির রাজাপুর উপজেলা বিএনপির শক্ত ঘাটি হিসেবে পরিচিত। এই উপজেলার সাঙ্গর গ্রামের সন্তান বিএনপির সাবেক এমপি কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহ্জাহান ওমর বীরউত্তম। ১৯৭৯, ১৯৯১, ১৯৯৬ (ষষ্ঠ সংসদ) ও ২০০১ সনে তিনি ঝালকাঠি-১ আসনে এমপি ছিলেন। এমনকি ২০০১ সালে চার দলীয় সরকারের সময় তিনি ভূমি ও আইন প্রতিমন্ত্রীর দ্বায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখিত সময়ে এলাকার উন্নয়নের পাশাপাশি নেতা কর্মীদের মাঝেও একটি শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করেন তিনি। এরপর দল ক্ষমতায় না এলেও সেই অবস্থান ধরে রেখেছেন। কিন্তু ২০০৭ সালে তত্তাবধায়ক সরকারের অধিনে সংসদ নির্বাচনের সময় এই আসন থেকে বিএনপি দলীয় মনোয়ন পান জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম জামাল। ঐ নির্বাচনে রফিকুল ইসলাম জামাল নির্বাচিত হতে পারেননি। তারপর থেকেই জামাল এই আসনে ওমরের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হয়ে মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।
রাজাপুর উপজেলা বিএনপির সদস্য গোলাম কিবরিয়া বরকত বলেন, শাহ্জাহান ওমর জীবিত থাকা অবস্থায় এই আসনে তার কোন বিকল্প হবেনা। রাজনীতিতে ব্যারিস্টার শাহ্জাহান ওমরের অভিজ্ঞতা দীর্ঘ দিনের। এছাড়া তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান। বিগত দিনে নেতাকর্মীদের পাশে থেকে সহযোগীতা করায় তার ইমেজ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। এবার তিনি ছাড়া অন্য কেহ মনোনয়ন পাবে এটা আমরা বিশ্বাস করিনা। রাজাপুর উপজেলা বিএনপির আরেক সদস্য মোঃ মনিরুজ্জামান শামিম বলেন, এই আসন থেকে এবার রফিকুল ইসলাম জামাল মনোনয়ন প্রাত্যাশী হলেও রাজাপুরের কোন কর্মসূচীতে তাকে আমরা পাইনা। তিনি মাঝে মধ্যে ঝালকাঠি বিএনপির কর্মসূচীতে যোগ দিয়ে ঢাকায় চলে যান। শাহ্জাহান ওমরের সঙ্গে এলাকার নেতাকর্মীদের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। অপর দিকে এই আসনের কাঠালিয়া উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জালালুর রহমান আকন উপজেলা বিএনপির কমিটিতে দ্বন্দ্বের কথা স্বিকার করে বলেন, ওমর এবং জামাল সমর্থক দুটি গ্রুপে বিভক্ত কাঠালিয়া বিএনপি। তবে ওমরের সমর্থিত নেতা কর্মীরা কোন কমিটিতে নেই। তারা তাদের গায়ের জোরে চলছে। আমরা জামাল ভাইয়ের সমর্থনে জেলা কমিটির নির্দেশনায় দলীয় কর্মসূচী পালন করছি। প্রার্থী হিসেবে আমরা জামাল ভাইকে যোগ্য মনে করছি। তিনি নেতা কর্মীদের মূল্যায়ন করেন। তিনি এলাকায়ও আসেন। আমরা ব্যাক্তির দল করিনা। দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার নির্বাচন করব। রাজাপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি তালুকদার আবুল কালাম আজাদ বলেন, এখন পর্যন্ত রাজাপুর উপজেলা বিএনপি এ আসনে শাহ্জাহান ওমর ছাড়া অন্য কোন প্রার্থীর চিন্তা করেনা। এখানে আরেক জন প্রার্থী জামালের নাম শোনা গেলেও ঝালকাঠি শহরেই তার তৎপরতা দেখা শোনা যায়। এলাকার রাজনীতিতে তিনি সম্পৃক্ত থাকেন না। অপর দিকে ওমর সাহেব কেন্দ্রীয় পদে থাকলেও মাসে অন্তত দু’বার এলাকায় এসে আমাদের সাথে বসেন এবং খোঁজ খবর রাখেন। এ আসনের ১২ টি ইউনিয়নেই তিনি ছুটে চলেন সমান তালে।
এ আসনে ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৫৫ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ৮৯ হাজার ২৬৯জন এবং নারী ভোটার ৮৮ হাজার ৯৮৬জন।