নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ পণ্যমূল্যে মানুষ যখন দিশে হারা, তখনো দেশে বাড়ছে কোটিপতির সংখ্যা। গত এক বছরে দেশে কোটিপতির সংখ্যা সাত হাজার বেড়ে হয়েছে দুই লাখ ১৩ হাজার ৫৮৬ জন। এসব কোটিপতির হাতে দেশের মোট আমানতের ৪২.৩৫ শতাংশই বিত্তশালীদের হাতে পুঁঞ্জীভূত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে গ্রামে আমানত কমে হয়েছে ঋণাত্মতক ২২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যেখানে শহরে বেড়েছে ৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ। অথচ ২০০৬ সালে দেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল সাড়ে আট হাজার। এ হিসাবে গত ১৬ বছরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে এক লাখ পাঁচ হাজার জন। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর ভিত্তিক হালনাগাদ প্রতিবেদন গতকাল প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে উঠে আসে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা। সংশি¬ষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে নানা সঙ্কট আর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির যাঁতাকলে পিষ্ট নিু ও মধ্যবিত্তরা। সাধারণ মানুষ সংসারের ব্যয় মেটাতে পারছে না। ছোট ছোট অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করতে পারছে না।
ব্যাংকে টাকা জমানো তো দূরের কথা, অনেকে আগের জমানো অর্থ ভেঙে খাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতেও এক শ্রেণীর মানুষের আয় বেড়েছে। এরা বিত্তশালী বা বড় প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর শেষে দেশে মোট আমানতের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১৭ লাখ ১৩ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, কোটি টাকার হিসাব মানেই কোটিপতি ব্যক্তির হিসাব নয়। কারণ ব্যাংকে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ রাখার তালিকায় ব্যক্তি ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আবার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কতটি ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। ফলে এক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির একাধিক হিসাবও রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কোটি টাকার হিসাবও রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজার ৬৮৪টি। এসব হিসাবে জমা আছে ১৭ লাখ ১৩ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা।
এর মধ্যে এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে, এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা রয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৫৮৬টি। কোটি টাকার উপরে এসব হিসাবে জমা আছে সাত লাখ ২৫ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের ৪২ দশমিক ৩৫ শতাংশ কোটি টাকার হিসাবধারীদের।
২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪ কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ১৯২টি। এসব হিসাবে জমা আছে ১৬ লাখ ৮৭ হাজার ২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে- এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা রয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৫৫৪টি। এই হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে কোটি টাকার হিসাব বেড়েছে ৩২টি আর এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে সাত হাজার ৬৬টি। এক বছর আগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে কোটি টাকার হিসাব ছিল এক লাখ ছয় হাজার ৫২০টি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক কোটি এক টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকার আমানতকারীর হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৯ হাজার ৭৬০টি। যেখানে জমা ছিল এক লাখ ৮৭ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা। পাঁচ কোটি এক টাকা থেকে ১০ কোটি ১২ হাজার ২২১টি হিসাবে জমার পরিমাণ ৮৬ হাজার ৩১২ কোটি টাকা।
এ ছাড়া ১০ কোটি থেকে ১৫ কোটি টাকার হিসাবের সংখ্যা রয়েছে চার হাজার ৭৪টি, ১৫ কোটি থেকে ২০ কোটির মধ্যে এক হাজার ৯৬৮টি, ২০ কোটি থেকে ২৫ কোটির মধ্যে এক হাজার ২৭৪টি, ২৫ কোটি থেকে ৩০ কোটির মধ্যে রয়েছে ৯১৯টি আমানতকারীর হিসাব।
আর ৩০ কোটি থেকে ৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ৫১২টি এবং ৩৫ কোটি থেকে ৪০ কোটির মধ্যে রয়েছে ৩৪৩টি, ৪০ কোটি থেকে ৫০ কোটি টাকার হিসাব সংখ্যা ৭৪৭টি। তা ছাড়া ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা হিসাবের সংখ্যা এক হাজার ৭৭৮টি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল পাঁচজন, ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে কোটিপতিদের হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ৯৮টি। এর পর ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি, ১৯৯৬ সালে দুই হাজার ৫৯৪ জন, ২০০১ সালে পাঁচ হাজার ১৬২টি, ২০০৬ সালে আট হাজার ৮৮৭টি এবং ২০০৮ সালে ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি।
২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে এ আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৮৯০টি। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বেড়ে তা দাঁড়ায় এক লাখ ১৯৭৬ টিতে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সেই হিসাবের সংখ্যা ছিল এক লাখ ৯ হাজার ৯৪৬টি।