দূরযাত্রা রিপোর্ট ঃ সাগর-নদীতে ইলিশ আহরণে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হতে বাকি এক সপ্তাহ। তবে ১৩ অক্টোবর নিষেধাজ্ঞা শুরুর পর ১৫ দিনের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। বিগত বছর গুলোর মতো এবারও নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইলিশ নিধন হচ্ছে। বরং আগের বছর গুলোর তুলনায় এ বছর নিষেধাজ্ঞা অমান্যের মাত্রা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। ইলিশ নিধন সুগন্ধা ও বিষখালী নদীতে চলছেই বলে দেখা ও শোনা যাচ্ছে। ইলিশ ধরা জেলে ও জেলে সংগঠকদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। ব্যর্থতার দায় মৎস্য বিভাগের নানা সংকট এবং মাঠ কর্মকর্তাদের অসাধুতা। তাদের মতে ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার’ মৎস্য বিভাগ এরকমই। জানা গেছে দেশে আরহিত মোট ইলিশের ৬৬ ভাগ আসে বরিশাল বিভাগ থেকে। বিশাল জল সিমায় মাছ নিষেধজ্ঞা কার্যকর করায় প্রধান হাতিয়ার জনবল ও জলযান দুই ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানটি অন্য সরকারি দপ্তর গুলোর উপর নির্ভরশীল। সবগুলো দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে যথাসময়ে তারা নদীতে অভিযানে যেতে পারছে না। অভিযানে স্থানীয় ভাবে ভাড়া করা স্পিট বোট ও ট্রলারের উপর তারা নির্ভরশীল। এসব বোট ও ট্রলার মাঝিরাই হয়ে যান নিষেধজ্ঞা অমান্যকারী জেলেদের সোর্স। অভিযানে আযোজন চলার মধ্যে জেলেদের কাছে খবর পৈাছে যায়। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ৮০ ভাগ ইলিশের পেটে ডিম আসে আশ্বিন মাসে। ডিম ছাড়ার জন্য মা ইলিশ সাগর থেকে মিঠা পানির সন্ধানে নদীতে ছুটে আসে। তাদের উপযুক্ত সময় হলো আশ্বিনের পূনিমা ও অমাবস্যা। ইলিশ সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষে মা ইলশের প্রজনন নিরাপদ করার জন্য ২০০৮ সালে ১১ দিনের নিষেধজ্ঞা পালন শুরু হয়। ২০১৫ সাল থেকে নিষেধজ্ঞা ২২ দিনে উন্নীত হয়। তাছাড়া ইলিশ বড় হওয়ার সুযোগ দিতে অভ্যন্তরীন নদীর ৫ টি অভয়াশ্রমে প্রতিবছর মার্চ ও এপ্রিল দুই মাস মাছ নিধনে নিষেধজ্ঞা থাকে।
ব্যার্থতার যত কারন ঃ নদী সাগরে বিশাল জলসীমায় মৎস্য সম্পদ রক্ষায় মৎস্য অধিদপ্তরের জলযান হলো জেলায় একটি করে স্পিডবোট। নিষেধজ্ঞা কার্যকরে
অভিযানে যেতে হয়ে স্থানীয় ভাবে ভাড়া করা ট্রলার বা স্পিট বোটে। জানা গেছে এসব বাহনের মাঝিরাই অভিযানে রওনা হওয়ার আগেই জেলেদের কাছে খবর পোছনোর চুক্তি করেন। আবার আটক জেলে ও জব্দ করা জাল মুক্ত কারার লেনদেনে মধ্যস্থতা করেন তারা। লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে এই অবৈধ কার্যক্রম
চলে। এ প্রসঙ্গে মসৎ অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক নৃপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, শত শত জেলের বিরুদ্ধে মামলা ও সাজা দিয়ে ইলিশ নিধন বন্ধ
কারা যাবে না। জনসচেতনতাই একমাত্র ভরসা। মৎস্য অধিদপ্তর মূলত জনসচেতনা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। জেলেদের মধ্যে ভিতী তৈরী করার জন্য দেওয়া হয় মামলা ও সাজা।এতে খুব একটা সুফল মিলছে না বলে স্বিকার করেন তিনি। জলবল ও জলযানের তীব্র সংকটের স্বিকার করে বলেন,অভিযানের জন্য অনেক সময়
তাৎক্ষনিক ভাবে ম্যাজিষ্ট্রেট পাওয়া যায় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ও দেওয়া হয় না। বিগত বছর গুলোর এই তিক্ত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সমাধনের জন্য নিষেধাজ্ঞাকে কার্যকর করতে কোন উদ্যোগই নেয়া হয়না মৎস্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে। ইলিশ আহরনে নিষেধাজ্ঞা মৎস্য অধিদপএরর রুটিন কাজে পরিনত হয়েছে। ঝালকাঠি জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ি ১৩ অক্টোবর থেকে এই নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়ে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে। ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত ঝালকাঠি
জেলায় ৪১ টি মোবাইল কোটর্, ১৭টি ইলিশ অবতরন কেন্দ্রে ১২৮ টি অভিযান এবং ৭৪টি মাছের ঘাট পরিদর্শন করা হয়েছে। এছাড়াও ইলিশ বিক্রয় হয় কিনা দেখতে ২৭৩ আড়ত ও ২৯৮ টি বাজার পরিদর্শন করা হয়েছে। এ কদিনে মাত্র ৪৩২ মেঃটন ইলিশ আটক, ৮৭ হাজার টাকার ৪ হাজার ২৩২ মিটার জাল আটক করা হয়েছে। মামলা করা হয়েছে মাত্র ৩টি। জরিমানা করা টাকার পরিমান মাত্র ১৫ হাজার টাকা। ৩ জন জেলেকে জেল দেয়া হয়েছে। নিলামের মাধ্যমে আয় হয়েছে মাত্র ২০ হাজার টাকা। নিষেধাজ্ঞার শুরতে জেলায় ৩ হাজার ৭৫০ জন জেলেকে ৯৩.৭৫ মেঃটন চাল দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় খোঁজ নিয়ে এবং ইলিশ ধরা জেলেদের সাথে কথা বলে জানাযায়, মৎস্য বিভাগের ইলিশ ধরাা থেকে বিরত রাখতে কোন তৎপরতাই এবার কাজে লাগেনি। কারণ হিসাবে তাদের যুক্তি হলো মৎস্য বিভাগের একমুখি অভিযান। এ বিষয়ে রাজাপুরের বিষখালী নদীতে এবার একটানা ইলিশ ধরা মৌসুমি জেলে সোহরাব হোসেন বলেন, অভিযান দ্বিমুখি হলে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হতো। যেমন সুগন্ধা বিষখালী নদীতে ২টি করে ৪টি পরস্পর বিপরীত মুখি স্পিটবোট ও ট্রলার নিয়ে অভিযান চালালে মাছ ধরা সম্ভব হতো না।
বিষয়টি আরো পরিস্কার হতে নদী তীরের বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১ কিলোমিটার দূরত্ব বজায় রেখে ২ টি যান দ্রুত গতিতে যে দিকে যাবে ঠিক তেমনি অপর ২টি যান বিপরীত দিক থেকে আসবে। সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ ভাবে যদি টহল বা অভিযান পরিচালনা করা যায় তাহলেই নিষেধাজ্ঞার সময় ইলিশ ধরা বন্ধ হতে পারে বলে বাসিন্দাদের অভিমত। গত ২৭ অক্টোবর রাজাপুরের পালট গ্রামের বিষখালী নদীতে নিষেধাজ্ঞার শুরু থেকে ইলিশ ধরা জেলে সোহাগ বেপারী ও মন্নান হাওলাদার জানান, আমার ৫০০ গ্রামের ১ কেজি ইলিশ মাছ বিক্রি করছি ১ হাজার থেকে ১২ টাকা। এ পর্য়ন্ত প্রায় অর্ধলাখ টাকার মাছ ধরে বিক্রয় করেছি। অভিযান ও মৎস্য বিভাগের তৎপরতার মাঝেও কিভাবে মাছ ধরে জানতে চাইলে তারা বলেন, কিছু ম্যানেজ প্রক্রিয়াতো থাকেই। এছাড়া অভিযান একবার নদীর এক দিকে হলে সে দিন আর কেহ আসেনা। তাই বাকি সময় নিশ্চিন্তে ধরা যায়। তবে ঝালকাঠি জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ৬৫ কিলোমিটারের সুগন্ধা বিষখালী নদীতে নিষেধাজ্ঞার এই সময়ে মৌসুমি জেলেদের কতটা বিরত রাখা সম্ভব হয়েছে তা আমি বলতে পারিনা। তবে চেষ্টা করেছি। আমরা অভিযান ছাড়াও কোন সংবাদ পেলে সেখানে ছুটে যাই। তবে নৌবাহিনী বা কোষ্টগার্ডের কোন কার্যক্রম নেই। তাই আমার চলে আসার পর তারা আবার নেমে পরে নদীতে। সামনের বছর আমরা আরো বেশি টহলের প্রস্তুতি নিয়ে নদীতে থাকব। তিনি আরো জানান এবছর অভিযানের জন্য মাত্র ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।