দূরযাত্রা রিপোর্ট ঝালকাঠি-২ (ঝালকাঠি-নলছিটি) এর সাবেক সংসদ আমির হোসেন আমু ছিলেন মূর্তিমান আতংক এ আসনে। ৬ নভেম্বর ঢাকায় তার গ্রেফতার খবরে ঝালকাঠিতে মিষ্টি বিতরণ ও আনন্দ মিছিল হয়েছে। সাধারন মানুষের পাশাপাশি মিষ্টি বিতরণ করেছে বিএনপি দলীয় নেতাকর্মীরাও। ঝালকাঠি জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্যরাও মিষ্টি বিতরন করেন। সন্ধ্যার পর জেলা শ্রমিক দল আমুর ফাঁসি দাবি করে বিক্ষোভ ও মিষ্টি বিতরণ করেছে।
বুধবার বেলা দেড়টার দিকে পশ্চিম ধানমন্ডির একটি বাসা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। আমির হোসের আমুর গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান। তিনি বলেন, আমুর বিরুদ্ধে হত্যাসহ ১৫টি মামলা রয়েছে। তিনি ১৪ দলের সমন্বয়ক ছিলেন।
আমুকে গ্রেপ্তারের খবর ঝালকাঠিতে ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন ভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে সাধারণ মানুষ। দুপুরে বিভিন্ন সংগঠন, সাধারন মানুষ ও জেলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে আনন্দ মিছিল করে ও মিষ্টি বিতরণ করা হয়। এ সময় বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও উপস্থিত
ছিলেন। আইনজীবী ও বিএনপি নেতাকর্মীদের আমির হোসেন আমুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা যায়। তাঁরা আমির হোসেন আমুর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। আনন্দ মিছিল শেষে বিএনপি নেতারা বলেন, আমির হোসেন আমু বিনা ভোটে এমপি হয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ছিল। তিনি বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলাসহ অত্যাচারের ষ্টিম রোলার চালিয়েছে। আওয়ামীলীগ সরকারের প্রায় ১৬ বছরে একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছিল জেলায়, যারা আমুর হয়ে জেলার সব ধরনের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ বাণিজ্য, কমিটি গঠন, নির্বাচনী মনোনয়ন বিক্রি করত। এই চক্রের আমু ছিলেন গডফাদার।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনা দেশ ছাড়েন। এরপর আমুর ঝালকাঠি বাড়িতে বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। পরে ওই বাড়ি থেকে বিদেশি মুদ্রাসহ ৫ কোটি কোটি টাকা উদ্ধার করে সেনাবাহিনী ও পুলিশ। এর আগেই আমু পালিয়ে যান।
বিএনপি নেতারা আমির হোসেন আমুর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। পরে জেলা যুবদল নেতাকর্মীরা শহরে একটি আনন্দ মিছিল বের করে। মিছিল শেষ স্থানীয় প্রেসক্লাবের সামনে এসে শেষ হয়। আনন্দ মিছিলে উপস্থিত ছিলেন, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও জেলা বিএনপির সদস্য সচিব শাহাদাৎ হোসেন, জেলা যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক রবিউল ইসলাম তুহিন ও শ্রমিক দলের আহবায়ক টিপু সুলতানসহ আরও অনেকে।
ঝালকাঠি জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান মুবিন বলেন, আমু ঝালকাঠি জেলা আইনজীবী সমিতি তার কব্জায় রাখতে আব্দুল মন্নান রসুলকে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে একটানা ১৫ বছর পিপি নিযুক্ত রাখেন। ১২ বছর মন্নান রসুলকে জেলা বারের সভাপতি পদে বিনা ভোটে নির্বাচিত করেন। মন্নান রসুল বারের সভাপতি থাকার জন্য আমুর প্রভাব খাটিয়ে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের নির্বাচন থেকে বিরত রাখতে বোমা ফাটিয়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানী করিয়েছে।
ঝালকাঠির সুইপার কোলনী নির্মান থেকে শুরু করে এ আসনের সব কাজের জন্য তিনি ১০% কমিশিন নিয়ে কার্যাদেশ দিতেন। তার বরিশাল ও ঢাকার বাস ভবনে বসে ব্যাংকের সিলমহরযুক্ত টাকার বান্ডিল ছাড়া কমিশনের টাকা নিতেন না। নলছিটি পৌর কাউন্সিলর ফিরোজ আলম খানের ছেলে আমুর ঢাকা ইস্কাটনের বাসভবনে কম্পিউটার অপারেটর শাওন খান আমুর নাম ভাঙ্গিয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকার মালিক হয়েছে। বিভিন্ন চাকুরীর বিনিময়ে উৎকোচ ও প্রকল্পের অনুমোদন করিয়ে শাওনের মাধ্যমে আমু টাকা নিতেন। সেই সুবাধে শাওন খান রাতারাতি কোটিপতি। এছাড়া স্কুলের নিয়োগ বাণিজ্য, কাবিখা, কাবিটাসহ বিভিন্ন ছোট ছোট প্রকল্প থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ এমনকি বিভিন্ন অফিসে সুইপার নিয়েগের বিনিময়েও টাকা নিতেন আমির হোসেন আমু। তার কোন সন্তান ও স্ত্রী না থাকলেও এভাবে বিপুল পরিমান অর্থ সম্পদ করেছেন।
ঝালকাঠিতে গড়ে ছিলেন সন্ত্রাসের রাজত্ব। ছাত্রলীগ যুবলীগ ও আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে একটি সন্ত্রাস বাহিনী গঠন করা হয়। আমু এলাকায় না থাকলে তার অনুপস্থিতিতে এরাই প্রশাসন ম্যানেজ করে যা ইচ্ছা তাই করতেন। এদের বিরুদ্ধে কেহ প্রতিবাদতো দূরের কথা মামলা করতে গেলে থানায় মামলাও নিতনা।
বিশেষ করে ঝালকাঠির ৩ পৌর কান্সিলর যুবলীগ নেতা রেজাউল করিম জাকির, কামাল শরীফ ও হাফিজ আল মাহমুদ এবং আওয়ামীলীগ নেতা তরুন কর্মকার ছিলেন আমুর চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী এবং নিয়োগ বানিজ্যের সিন্ডিকেট প্রধান। তখন ডিসি, এসপি, ওসিসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা আমুর অনুপস্থিতিতে এ ৪ নেতার
নির্দেশনায় প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করতেন। অপরদিকে আদালতের বিষয়টি দেখতেন আমুর ঘনিষ্ট এ্যাডভোকেট মান্নান রসুল। যিনি আসামী ও বাদী দুই পক্ষের কাছ থেকে টাকা নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিচারকদের উপর প্রভাব খাটাতেন তিনি। তার কথা না শুনলে ঐ বিচারককে বদলী হয়ে চলে যেতে বলতেন বলেও
শোনা গেছে। এভাবে উপার্জিত অর্থের একটা অংশ পেতেন আমু। তাই তৎকালিন বিচারকদের উপর প্রভাব খাটিয়ে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত করতেন সাধারন মানুষদের। এসব কর্মকান্ডে ক্রমান্বয়ে সাধারন মানুষ অতিষ্ট হয়ে কিছু বলতে না পেরে আমুর উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে । যার বহিপ্রকাশ ঝালকাঠিতে মিষ্টি বিতরন।
আমির হোসেন আমুর পাশাপাশি তার ক্যাডাররা এলাকায় নজিরবিহীন সন্ত্রাস নৈরাজ্য করায় আমু অভিযোগ পেয়েও কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় মানুষ এতোদিন জিম্মি হয়ে ছিল।
এলাকার মানুষের সাথে আমুর কোন যোগাযোগ ছিল না। তিনি মাঝে মাঝে কিছু প্রকল্পের উদ্বোধন এবং কমিশনের টাকা নিতে ঝালকাঠি আসতেন। কোন দিন ঝালকাঠির বাস ভবনে থাকেননি। এমনকি বছরে একবারও এলাকার মানুষের সুখ দুঃখ বা তাদের কোন কথা শুনতেন না। তাকে ঘিরে রাখত তার সিন্ডিকেটরা। দলীয় কজন নারী নেত্রী আমুর পাশে বসে তার পা ও শরীল ম্যসাজ করে দেয়ার ছবিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হতে দেখা গেছে। পরবর্তিতে ঐসব নেত্রীরা বিভিন্ন ঠিকাদারী ও প্রকল্পের কাজ করে রাতারাতি কোটিপতি এবং বিলাসবহুল বাড়ি গাড়ির মালিক হতে দেখো গেছে। তারাও আমুর সাথে গাঢাকা দিয়েছে।