ঝালকাঠি প্রতিনিধিঃ ঝালকাঠি সরকারি হরচন্দ্র বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শতবর্ষী পুকুর ভরাটের প্রস্তুতি বন্ধ করে দিলেন জেলা প্রশাসক আশরাফুর রহমান। ফলে একদিকে যেমন স্বস্তি পেয়েছেন এলাকাবসি অন্যদিকে এই এলাকার আগুন দূর্ঘটনা প্রতিরোধের একমাত্র পুকুরটি রক্ষা পেল। যদিও ঝালকাঠির পরিবশে আন্দোলনের
কোন এনজিও বা সংগঠন এ বিষয়ে প্রকিবাদ না করে নিরব।
ঝালকাঠি শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর ও স্কুল কর্তৃপক্ষ এই আত্মঘাতি সিদ্ধান্তটি নিয়ে ছিল। ২০২৪ সনের ৫ আগষ্ট আওয়ামীলীগ সরকার পতনের ১৫ দিন পর ২১ আগষ্ট সাড়ে ৮ কোটি টাকা প্যাকেজ মূল্যে এ কাজের ঠিকাদার নিযুক্ত হন জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক রেজাউল করিম জাকির এর প্রতিষ্ঠান মুনমুন কনস্ট্রাকশন।
একাধিক মামলার আসামী হয়ে ঠিকাদার রেজাউল করিম জাকির পলাতক থাকায় স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক নূরুল ইসলামের সহায়তায় এবং শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের যোগসাযসে পুকুরটি ভরাটের কাজ শুরু করে। জাকির আত্মগোপনে থাকায় তার পক্ষে বড় ভাই জেলা আওয়ামীলীগ নেতা মানিক হাওলাদার বালু ব্যবসায়ী নুরুজ্জামানকে দিয়ে পুকুরটি ভরাটের কাজ শুরু করেন।
সরজমিনে গত ২৬ মে সুগন্ধা নদীর ডিসি পার্ক সংলগ্ন এলাকা থেকে স্কুলটি পর্যন্ত পাইপ লাইন টানার কাজ শুরু হয়। গত ২৭ মে স্কুলটির দেয়াল ছিদ্র করে পাইপ বসানোর পরে সাংবাদিকদের নজরে পড়ে বিষয়টি। এরপর দেখা যায় স্কুলের ভেতরে থাকা শতবর্ষী পুকুরটি পর্যন্ত এই লাইন টানা হয়েছে। গত মঙ্গলবার বেলা ১২টা
পর্যন্ত পুকুরটির তিন ভাগের একভাগ অংশে বালু ফেলা হয়। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধমে সমালোচনার ঝড় উঠলে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ঝালকাঠি সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইফুল ইসলাম স্কুলে গিয়ে বালু ফেলা বন্ধ করে দেন।
বর্তমান ঝালকাঠি সরকারি হরচন্দ্র বালিকা উচ্চবিদ্যালয়টি প্রায় দেড় একর জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। এর প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৪৭ সালের ২ জানুয়ারি লেখা হলেও আদি প্রতিষ্ঠাকাল ১৯১৭ সাল। যার নাম ছিলো গণেশ দাস বালিকা বিদ্যালয়। এ মাধ্যমিকে উন্নীতর ৯ বছর পর ১৯৫৬ সালে নাম বদলে হরচন্দ্র বালিকা উচ্চবিদ্যালয় রাখা হয়। বিদালয়টি সরকারিকরণ হয় ১৯৭৭ সালে। এই কম্পাউন্ডে শত বছর ধরে থাকা ১২.৮২ শতাংশের পুকুরটি ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভেসহ (সিএস) অন্যান্য জরিপেও রেকর্ডভুক্ত। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিকালে স্কুলে স্থাপিত প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা পুকুরটি ব্যবহার করেছেন। জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০
অনুযায়ী কোনো পুকুর, জলাশয়, খাল, লেক ভরাট করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইনের ৮ নম্বর ধারায় অমান্যকারীর ৫ বছর কারাদণ্ডের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া পুকুর ভরাট পরিবেশ সংরক্ষণ আইনেও নিষিদ্ধ। শুধু রেকর্ডীয় পুকুর নয় ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুর প্রাকৃতিক জলাধার বলে ২০২০ সালে হাইকোর্টের এক রায়ে
উল্লেখ করা হয়েছে। হাইকোর্টের এই রায়টি যার রিটের ফলে এসছিলো সেই আইনজীবী হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট এডভোকেট মনজিল মোরসেদকে ঝালকাঠি সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের পুকুর ভরাটের সুযোগ আছে কিনা এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, সিএস এমনকি বিএস রেকর্ডেও যদি এটি পুকুর হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকে, এটি ভরাট করা যাবে না। ভবন নির্মাণেরতো প্রশ্নই আসে না। যদি কোনো রেকর্ডে না থাকে তখনও এটি পানি আইনে সুরক্ষা পাবে।
ঝালকাঠি শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী স্নেহলতা রায় বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি। ফাইল ঘেটে যতটুকু জেনেছি, ২০২৩ সালে ঝালকাঠি সরকারি হরচন্দ বালিকা বিদ্যালয়ে একটি ৬ তলা ভবন নির্মাণের জন্য মাটি পরীক্ষা করে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। মাটি পরীক্ষার সময় স্কুল কর্তপক্ষ পুকুরটিকে
একটি ডোবা হিসেবে দেখায়। টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষে ২০২৪ সালের ২১ আগস্ট ওই সময়ের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল করিম জাকিরের প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ প্রদান করেন। দীর্ঘ নয়মাসে কোন কাজ শুরু না করলেও হঠাৎ করে গত মঙ্গলবার আমাদের কিছু না জানিয়ে ঠিকাদারের লোকজন বালু দিয়ে পুকুর ভরাট শুরু করে। যেহেতু এটি রেকর্ডীয় পুকর তাই ভরাট করে ভবন নির্মাণের সুযোগ নেই। আমাদের না জানিয়ে পুকুর ভরাটের উদ্যোগ নেয়ায় ঠিকাদারকে কারণ দর্শাতে বলা হবে।
ভবন নির্মানের ঠিকাদার জেলা যুবলীগ আহ্বায়ক রেজাউল করিম জাকির ও তার বড় ভাই মানিক হাওলাদারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলে নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। তাদের পক্ষে বালুদিয়ে পুকুরভরাটকারী সাবকন্টাক্টর মো. নুরজ্জামান বলেন, যুবলীগ নেতা রেজাউল করিম জাকিরের বড় ভাই মানিক ভাইর নির্দেশে প্রধান শিক্ষকের পরামর্শে মঙ্গলবার আমি স্কুলের দেয়াল ভেঙ্গে পুকুরে বালু ফেলা শুরু কওে ছিলাম। এসিল্যান্ড স্যার কাজ বন্ধ রাখতে বলায় আমরা পাইপ খুলে কাজ বন্ধ রেখেছি।
ঝালকাঠি সরকারি হরচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নূরুল ইসলাম বলেন, পুকুরটি অব্যবহৃত থাকায় ভরাটের অনুমতি দিয়ে ছিলাম। পুকুরের চেয়ে আমাদের ভবনটি বেশী দরকার। অপ্রয়োজনীয় পুকুরটি ভরাটের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরে আবেদন করবো। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব অন্তরা হালদার বলেন,
পুকুর ভরাটের খবর পেয়ে তাৎক্ষনিক জেলা প্রশাসক স্যারের নিদের্শে এসি ল্যান্ডকে পাঠিয়ে ভরাটের কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে জলাশয়টি পুকুর বলেই মনে হচ্ছে। কাগজপত্র যাচাইবাছাই করে এটি রেকর্ডীয় পুকুর হলে ভরাট করতে দেয়া হবে না। জলাধার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হবে।