মো. শাহীন আলম, ঝালকাঠিঃ একটি পরিবারের আশার প্রদীপ নিভে গেছে জুলাইয়ে স্বৈরাচার সরকারের বুলেটের আঘাতে। ঝালকাঠির শেখেরহাট ইউনিয়নের গ্রাম শীরযুগ। এই গ্রামে শহীদ মো. হৃদয়ের পরিবারে গভীর শোক বেদনা আর শূন্যতা বিরাজ করছে এখনো। মা, বাবা, ভাই, বোন শোকে মূহ্যমান। এই ভাঙ্গা ঘরেই বড় হয়েছে শহীদ হৃদয় হাওলাদার। ১৯ জুলাই ছিল তার প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী। তার একটি ভাল সুন্দর ঘরের আশা এখন পরিবারের সবার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়ে আছে।
গত বছর ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই ঢাকার মিরপুর-১০ এলাকায় ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী গণ-আন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন মো.
হৃদয়। বাবা মো. শহীদ হাওলাদার কেঁদে কেঁদে বলেন, হৃদয় ঢাকায় একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করতো। অল্প অল্প করে টাকা জমাতো। বলতো,
বিদেশে যাবে, টাকা পাঠাবে, আমাদের একটা ভাল ঘর হবে। যে ঘরে বৃষ্টির সময় টিন দিয়ে পানি পরবেনা। বৃষ্টি হলেই পানির চিন্তায় বসে থাকতে
হবেনা। আমাদের বাবায় বলছিল, বাবা একটু ধৈর্য ধরো, আমি কিছু টাকা পাঠালে ঘর মেরামত করে নিও। বিদেশ যাবার পর পাকা ঘর হবে
ইনশাআল্লাহ। কিন্তু নিয়তির কারণে সেই ঘর আগের মতোই ভাঙা পড়ে আছে, নেই আমার বাবায়।
মা কুলসুম বেগম স্মৃতিচারন করে বলেন, ওর ফোন আসতো সকালে। বলতো মা, ভাত খেয়েছো। আমি বলতাম, খেয়েছি বাবা, তুই খেয়েছিস। ও বলতো, আমি
দোকানে এসেছি মা। সন্ধ্যায় ফোন দিবো। এখন আর সকালে কেহ আমাকে খাবার খেতে খোঁজ নেয়না। ফোন আসেনা বলে অঝোর ধারায় কাঁদেন কুলসুম। যখনই বাবার কথা মনে পরে তখনই ওর জামা কাপুড়ের কাছে গিয়ে গন্ধ নেই।
মনে করে হাউমাউ করে কেঁদে মনটাকে একটু হালকা করার চেষ্টা করি। এভাবেই দিন যাচ্ছে আমার। ঢাকার কালশী কবরস্থানে ঘুমিয়ে আছে আমার বাবা। হৃদয়ের মরদেহ নিজ গ্রামে আনাও সম্ভব হয়নি বলে বাবা মো. শহীদ হাওলাদার জানান। যেদিন দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে গেল কোনো এম্বুলেন্স পেলামনা। হাসপাতালে প্রবেশ
করতে না দেয়ায় টাকার অভাবে ফ্রিজি করা সম্ভব হয়নি। পরে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় ঢাকার মিরপুর ১১ এর মাক্কী মসজিদে ফজরের নামাজের পর শতশত মুসল্লীদের উপস্থিততে কালশী কবরস্থানে বাবা হৃদয়কে দাফন করতে হয়। এখন কবরটাও ঠিকমতো দেখি না, এতদূরে যাওয়া আমাদের পক্ষে কষ্টসাধ্য। সরকারের প্রতি বাবা মায়ের আবদার অন্তত ছেলের কবরটা যেন সংরক্ষণ করা হয়। এই ছেলেটা তো দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে, তার স্মৃতিটা যেন হারিয়ে না যায়। আমরা শুধু চাই ছেলের রক্তটা বৃথা না যাক।
বাবা শহিদ হাওলাদার আরো জানান, আর্থিক সহযোগিতা কিছু পেয়েছি, তবে স্থায়ী ভাতাটা হলে আমরা একটু ভাল থাকতে পারতাম। সরকার ও বিভিন্ন
মাধ্যম থেকে আমরা কিছু সহযোগিতা পেয়ে খুশি। স্থানীয় প্রশাসনও খোঁজ নিচ্ছে। ভাতাটা পেলে অন্তত আমার ছোট ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যতটা একটু
গুছিয়ে নিতে পারবো। কাজ করতে পারি না। ছেলেটার ওপর নির্ভর ছিলাম। হৃদয়ের ছোট ভাই স্কুল পড়ুয়া রিয়াদ হাওলাদার বলেন, ভাইয়া বলতো, আমার
জন্য নতুন বই কিনে দেবে। স্কুলে ভালো রেজাল্ট করলে পুরস্কার দিবে। এখন আমি কিছুই চাই না, শুধু চাই ওর মতো সাহসী হতে বাবা-মা বোনদের
দায়িত্ব নিতে। পরিবার চায় হৃদয়ের মতো শহীদদের যেন রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয় তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়ায়। মা কুলসুমের দাবি ছেলের নাম যদি শহীদের তালিকায় থাকে, তাহলে অন্তত বুকের ভিতর শান্তি পাবো। তাদের প্রার্থনা এই ত্যাগ যেন ইতিহাসে লেখা থাকে।